
‘সামান্য’ ঘটনা
(সুকুমার রায়)
এক-একটা সামান্য ঘটনা থেকে জগতে কত বড়ো-বড়ো কাণ্ড, কত আবিষ্কার, কত মারামারি, কত যুদ্ধবিগ্রহের আরম্ভ হয়েছে, সে কথা ভাবতে গেলে এক-এক সময় ভারি আশ্চর্য লাগে। আমাদের দেশে পুরাণে এরকম ঘটনার অনেক গল্প আছে। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের পর কৌরবদের মধ্যে যখন কেবল অশ্বত্থামা, কৃতবর্মা আর কৃপাচার্য, এই তিনজনমাত্র বাকি রইলেন, তখন অন্ধকার রাত্রে গাছের তলায় শুয়ে অশ্বত্থামা দেখলেন, একটা পেঁচা এসে কতগুলা ঘুমন্ত কাককে অনায়াসে মেরে রেখে গেল। তাতেই অশ্বত্থামার মনে হঠাৎ এই ফন্দি জাগল যে, ‘আমিও তো এমনি করে অন্ধকার রাত্রে পাণ্ডবশিবিরে ঢুকে যোদ্ধাদের মেরে ছারখার করে আসতে পারি।’ যেমন মনে হওয়া, অমনি সেইমতো কাজে লাগা। সেই রাত্রের ভয়ংকর ব্যাপারের কথা তোমরা মহাভারতে পড়েছ।
🕸️ছেলেবেলায় ইংরাজিতে রবার্ট ব্রুসের গল্প পড়েছিলাম। স্কটল্যান্ডের যোদ্ধা রাজা রবার্ট ব্রুস প্রবল শত্রুর কাছে বার বার পরাজিত হয়ে শেষটায় রাজ্যের আশা ছেড়ে দিয়ে এক পাহাড়ের গুহায় লুকিয়ে আছেন; এমন সময় তিনি দেখলেন একটা মাকড়সা একখানি সুতো ধরে বার বার গুহার মুখটাকে বেয়ে উঠবার চেষ্টা করছে আর বার বার পড়ে যাচ্ছে। কিন্তু তবু সে চেষ্টা ছাড়ছে না। অনেক চেষ্টার পর শেষে সে ঠিকমতো উঠতে পারল। তা দেখে রাজা রবার্টের মনেও ভরসা এল—তিনি ভাবলেন, আর-একবার চেষ্টা করে দেখি। সেই চেষ্টার ফলে তিনি জয়লাভ করে আবার তাঁর রাজ্য ফিরে পেলেন।
🕸️বিজ্ঞানবীর নিউটন তাঁর বাগানে বসে দেখলেন, গাছ থেকে একটা ফল মাটিতে পড়ল। ঘটনাটা নিতান্তই সামান্য, কিন্তু বিজ্ঞানের ইতিহাসে তার ফলাফল বড়ো সামান্য নয়। নিউটন ভাবতে বসলেন, ‘ফলটা মাটিতে পড়ল কেন? জিনিসমাত্রই শূন্যে ছেড়ে দিলে মাটিতে পড়ে কেন? চারিদিক জুড়ে এত প্রকাণ্ড আকাশ পড়ে আছে, তা ছেড়ে এই পৃথিবীর মাটির উপরেই তার এত ঝোঁক কেন?’ ভাবতে ভাবতে তিনি মাধ্যাকর্ষণের তত্ব আবিষ্কার করে ফেললেন। প্রথম, তিনি সিদ্ধান্ত করলেন যে, পৃথিবীটা তার আশেপাশের সমস্ত টানে। কিন্তু শুধু পৃথিবীই কি টানে? চন্দ্র সূর্য গ্রহ নক্ষত্র এদেরও কি সে শক্তি নেই? আর শুধু কাছের জিনিসকেই পৃথিবী টানে, অনেক দূর পর্যন্ত কি সে টান পৌঁছায় না? ভাবতে ভাবতে সিদ্ধান্ত হল এই যে, এই ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে প্রত্যেকটি জড়কণা অপর সমস্ত জড়কণার প্রত্যেকটিকে আকর্ষণ করে। যতদূরেই যাওয়া যায় সে আকর্ষণ ততই ক্ষীণ হয়ে আসে। এই পৃথিবী চন্দ্রকে টানছে চন্দ্রও পৃথিবীকে টানছে। পৃথিবীর প্রত্যেকটি পাথর, প্রত্যেকটি মাটির ঢেলা, প্রত্যেকটি ধূলিকণা পর্যন্ত জগতের আর-সমস্ত জিনিসকে আকর্ষণ করছে। নিউটন দেখালেন যে, এইভাবে গণনা করে দেখলে পৃথিবী গ্রহ উপগ্রহ প্রভৃতি সকলেরই চলাফিরার ঠিকমতো হিসাব পাওয়া যায়। বিজ্ঞানের ইতিহাসে এত বড়ো তত্বের আবিষ্কার আর দ্বিতীয় হয় নি বললেও চলে।
🕸️একটা মরা ব্যাঙের ঠ্যাঙের নাচন থেকে বিদ্যুৎপ্রবাহের আবিষ্কার হয়। গ্যালভানি(Galvani) নামে এক ইটালিয়ান পণ্ডিত পরীক্ষার জন্য একটা ব্যাঙ কেটে একটা লোহার শলাকায় ঝুলিয়ে রেখেছিলেন। খানিক পরে তাঁর স্ত্রী দেখেন, সেই মরা ব্যাঙের ঠ্যাংটা এক-একবার ঝুলে পড়ছে আর এক-একবার হঠাৎ লাফিয়ে উঠছে। তিনি যদি এটাকে ভূতুড়ে কাণ্ড ভেবে ভয়ে পালাতেন, তবে তাঁর আর বিদ্যুতের তত্ত্ব আবিষ্কার করা হত না। কিন্তু তিনি ভয় পেলেন না, বরং এই অদ্ভুত ব্যাপারের কারণ জানবার জন্য তাঁর কৌতূহল জেগে উঠল। তখন দেখা গেল, ঐ ব্যাঙের পায়ের নীচে এক টুকরো তামা রয়েছে, তাতে যতবার পা ঠেকছে ততবারই মরা ব্যাঙ নেচে উঠছে। গ্যালভানিও খবর পেয়ে দেখতে এলেন, আর পরীক্ষা করে দেখলেন যে, ওটা বিদ্যুতেরই কাণ্ড। এই যে এখন কত শহরে শহরে বিদ্যুতের কারখানা বসেছে, আর তারের মধ্যে বিদ্যুৎপ্রবাহ চালিয়ে ঘরে ঘরে পাখা চলছে, আলো জ্বলছে, এর গোড়াকার ইতিহাস যদি লিখতে হয় তবে তার মধ্যে ঐ ব্যাঙের নাচনটারও উল্লেখ থাকবে।
🕸️ভেড়ার লোম কেটে যে পশম তৈরি হয়, তাকে কাজে লাগাবার আগে তার জট ছাড়িয়ে আঁশ আল্গা করা দরকার। এই কাজ আগে হাতে করতে হত, পরে জট ছাড়াবার কলের সৃষ্টি হওয়াতে এখন কাজটা অনেকটা সহজ হয়ে এসেছে। যাদের চেষ্টায় এই কলের সৃষ্টি ও উন্নতি হয়, তাদের মধ্যে একজন ছিলেন হাইলম্যান নামে এক পশমওয়ালা। তিনি একদিন তাঁর মেয়েদের চুল আঁচড়ানো দেখে, মনে ভাবলেন, ‘এইরকম করে চিরুনি দিয়ে আঁচড়ে আঁচড়ে পশমের জট ছাড়ানো হয় না কেন?’ তিনি জট ছাড়াবার জন্য চিরুনির কল করলেন, তাতে পশমওয়ালাদের যে কত সুবিধা হয়ে গেল তা আর বলা যায় না। কিন্তু এর চাইতেও আশ্চর্য হচ্ছে সেলাইয়ের কলের ইতিহাস।
🕸️এলিয়াস্ হাউস আমেরিকার লোক; তাঁর বাল্যকালের শখ ছিল তিনি সেলাইয়ের কল বানাবেন। সে সময়ে সেলাইয়ের কাজ সমস্তই হাতে করতে হত, কিন্তু হাউস ভাবলেন, এতরকম কাজ কলে হচ্ছে, আর সেইটা হতে পারবে না কেন? তিনি বহুদিন ধরে এই বিষয় নিয়ে পরীক্ষা করলেন, কিন্তু ছুঁচসুদ্ধ সুতোটাকে কাপড়ের ভিতর দিয়ে পারাপার করাতে গিয়ে তিনি মহা সমস্যায় পড়ে গেলেন। নানারকম ফন্দি খাটিয়েও এই কাজটিকে তিনি কলে বাগাতে পারলেন না। তখন, একদিন রাত্রে তিনি অদ্ভুত স্বপ্ন দেখলেন—এক অসভ্য রাজা তাঁকে বন্দী করে হুকুম দিয়েছে, এখনই আমাকে সেলাইয়ের কল বানিয়ে দাও, যদি না দাও তো তোমায় মেরে ফেলব। স্বপ্নের মধ্যে সেলাইয়ের কল বানানো গেল না। রাজা হকুম দিলেন ‘মার একে’। তখন কতগুলো লোক বল্লম দিয়ে তাঁকে মারতে এল, সেই বল্লমের মুখের ফলকের মাথাটা ফুটো। তৎক্ষণাৎ হাউসের ঘুম ভেঙে গেল, তিনি উঠে বসতেই সর্বপ্রথমে তার মনে হল ‘বল্লমের মুখের কাছে ফুটো’! তিনি ভাবলেন, ‘এই তো ঠিক হয়েছে। কলের ছুঁচের পিছনে সুতো না দিয়ে, এরকম মুখের কাছে সুতো দিলেই তো অনেকটা সহজ হয়ে আসে।’ শেষকালে পরীক্ষায় তাই দেখা গেল—সেলাইয়ের কল করবার পক্ষে আর কোনো বাধাই রইল না। এই হল সেলাইয়ের কলের ইতিহাস।
🕸️এখানে সামান্য ঘটনাটি একটা স্বপ্ন মাত্র। এর পরে যখন সেলাইয়ের কল দেখবে, তখন এই কথাটি ভেবে দেখো যে, ওর আদি জন্মের ইতিহাসের মূল হচ্ছে একটি স্বপ্ন।
সন্দেশ(কার্তিক, ১৩২৪)
।। সমাপ্তি।।