মহাভারত-আদিপর্ব
(সুকুমার রায়)
হস্তিনায় চন্দ্রবংশ কুরুরাজকুল
রাজত্ব করেন সুখে বিক্রমে অতুল।
সেই কুলে জন্মি তবু দৈববশে হায়
অন্ধ বলি ধৃতরাষ্ট্র রাজ্য নাহি পায়।
কনিষ্ঠ তাহার পাণ্ডু, রাজত্ব সে করে,
পাঁচটি সন্তান তার দেবতার বরে।
জ্যেষ্ঠপুত্র যুধিষ্ঠির ধীর শান্ত মন
‘সাক্ষাৎ ধর্মের পুত্র’ কহে সর্বজন।
দ্বিতীয় সে মহাবলী ভীম নাম ধরে,
পবন সমান তেজ পবনের বরে।
তৃতীয় অর্জুন বীর, ইন্দ্রের কৃপায়
রূপেগুণে শৌর্যেবীর্যে অতুল ধরায়।
এই তিন সহোদর কুন্তীর কুমার,
বিমাতা আছেন মাদ্রী দুই পুত্র তাঁর–
নকুল ও সহদেব সুজন সুশীল
এক সাথে পাঁচজনে বাড়ে তিল তিল।
অন্ধরাজ ধৃতরাষ্ট্র শতপুত্র তার,
অভিমানী দুর্যোধন জ্যেষ্ঠ সবাকার।
পাণ্ডবেরা পাঁচ ভাই নষ্ট হয় কিসে,
এই চিন্তা করে দুষ্ট জ্বলি হিংসাবিষে।
হেনকালে সর্বজনে ভাসাইয়া শোকে
মাদ্রীসহ পাণ্ডুরাজা যায় পরলোকে।
‘পাণ্ডু গেল’, মনে মনে ভাবে দুর্যোধন,
‘এইবারে যুধিষ্ঠির পাবে সিংহাসন!
ইচ্ছা হয় এই দণ্ডে গিয়া তারে মারি–
ভীমের ভয়েতে কিছু করিতে না পারি।
আমার কৌশলপাকে ভীম যদি মরে
অনায়াসে যুধিষ্ঠিরে মারি তার পরে।’
কুচক্র করিয়া তবে দুষ্ট দুর্যোধন।
নদীতীরে উৎসবের করে আয়োজন—
একশত পাঁচ ভাই মিলি একসাথে
আমোদ আহ্লাদে ভোজে মহানন্দে মাতে।
হেন ফাঁকে দুর্যোধন পরম যতনে
বিষের মিষ্টান্ন দেয় ভীমের বদনে।
অচেতন হল ভীম বিষের নেশায়
সুযোগ বুঝিয়া দুষ্ট ধরিল তাহায়
গোপনে নদীর জলে দিল ভাসাইয়া
কেহ না জানিল কিছু উৎসবে মাতিয়া॥
এদিকে নদীর জলে ডুবিয়া অতল তলে
ভীমের অবশ দেহ, কেমনে জানে না কেহ,
কোথায় ঠেকিল শেষে বাসকী নাগের দেশে।
ভীমের বিশাল চাপে নাগের বসতি কাঁপে
দেহভারে কত মরে, কত পলাইল ডরে
কত নাগ দলে দলে ভীমেরে মারিতে চলে
সংশিয়া ভীমের গায় মহাবিষ চলে তায়।
অদ্ভুত ঘটিল তাহে ভীম চক্ষু মেলি চাহে
বিয়ে হয়ে বিষক্ষয় মুহূর্তে চেতনা হয়,
দেখে ভীম চারিপাশে নাগেরা ঘেরিয়া আসে।
দেখিয়া ভীষণ রাগে ধরি শত শত নাগে
চূর্ণ করে বাহুবলে, মহাভয়ে নাগ দলে
ছুটে যায় হাহাকারে বাসুকী রাজার দ্বারে।
বাসুকী কহেন, ‘শোনো আর ভয় নাই কোনো,
তুষি তারে সুবচনে আনো হেথা সযতনে।’
রাজার আদেশে তবে আবার ফিরিয়া সবে
করে গিয়া নিবেদন বাসুকীর নিমন্ত্রণ।
শুনি ভীম কুতূহলে রাজার পুরীতে চলে,
সেথায় ভরিয়া প্রাণ, করিয়া অমৃত পান,
বিষের যাতনা আর কিছু না রহিল তার,
মহাঘুমে ভরপুর সব ক্লান্তি হল দূর।
তখন বাসুকী তারে স্নেহভরে বারে বারে
আশিস করিয়া তায় পাঠাইল হস্তিনায়।
সেথা ভাই পরিজনে আছে শোকাকুল মনে,
কুম্ভীর নয়নজল ঝরে সেথা অবিরল,
মগন গভীর দুখে ফিরে সবে ম্লান মুখে।
হেন কালে হারনিধি সহসা মিলাল বিধি,
বিষাদ হইল দূর জাগিল হস্তিনাপুর,
উলসিত কলরবে আনন্দে মাতিল সবে।।
সন্দেশ(অগ্রহায়ণ-পৌষ, ১৩৩১)
।। সমাপ্তি।।