লক্ষ্মণের শক্তিশেল
(সুকুমার রায়)
পাত্রগণ
রাম, জাম্বুবান, সভাসদগণ, বিভীষণ, লক্ষ্মণ, দূত, সুগ্রীব হনুমান, বানরগণ, রাবণ, যমদূতদ্বয়, যম
।। প্রথম দৃশ্য।।
রামের শিবির
রাম। কাল রাত্তিরে আমি একটা চমৎকার স্বপ্ন দেখেছি। দেখলুম কি, রাবণ ব্যাটা একটা লম্বা তালগাছে চড়ছে। চড়তে-চড়তে হঠাৎ পা পিছলে একেবারে–পপাত চ, মমার চ!
🕸️জাম্বুবান। তবে হয়তাে রাবণ ব্যাটা সত্যিই সত্যিই মরেছে–রাজস্বপ্ন মিথ্যা হয় না।
🕸️সকলে। হয় না, হবে না–হতে পারে না।
🕸️রাম। আমি হনুমানকে বললুম, যা, ব্যাটাকে, সমুদ্রে ফেলে দিয়ে আয়। হনুমান এসে বললে কি, ফেলবারও দরকার হল না সে এক্কেবারে মরে গেছে।
🕸️সকলে। বাঃ বাঃ’—একদম মরে গেছে–ব্যাস। আর চাই কি, খুব ফুর্তি কর!
বাহিরে গোলমাল
ঐ দেখ রাবণের রথ দেখা যাচ্ছে দেখেছিস? ঐটা রাবণ, ঐ যে লাঠি কাঁধে–
🕸️সকলে। সে কি! রাবণ ব্যাটা তবু মরে নি, ব্যাটার জান তো খুব কড়া!
🕸️জাম্বুবান। এই হনুমান ব্যাটাই তো সব মাটি কললে–তখন রাবণকে সমুদ্রে ফেলে দিলেই গােল চুকে যেত–না, ব্যাটা আবার বিদ্যে জাহির করতে গিয়েছে–‘এক্কেবারে মরে গেছে–
🕸️বিভীষণ। চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে–
দূতের প্রবেশ
সকলে। কি হে, খবর কি?
🕸️দূত। আজ্ঞে, আমি এইমাত্র আসছি–
🕸️লক্ষ্মণ। ব্যস! মস্ত খবর দিয়েছ আর কি!
🕸️জাম্বুবান। এইমাত্র আসছ? তােপ ফেলতে হবে?
🕸️রাম। আজ কি ঘটল না ঘটল সব ভালাে করে গুছিয়ে বল।
🕸️দূত। আজ্ঞে, আমি ছান-টান করেই পুঁইশাক চচ্চড়ি আর কুমড়াে ছেঁচকি দিয়ে চাট্টি ভাত খেয়েই অমনি বেরিয়েছি–অবিশ্যি আজকে পাঁজিতে কুষ্মাণ্ড ভক্ষণ নিষেধ লিখেছিল, কিন্তু কি হল জানেন? আমার কুমড়ােটা পচে যাচ্ছিল কিনা।
🕸️সকলে। বাজে বকিস নে কাজের কথা বল্।
🕸️দূত। হ্যাঁ হ্যাঁ খেয়ে উঠেই ঘণ্টা দু-তিন জিরিযে সেখানে গিয়ে দেখি খুব ঢাক ঢোল বাজছে ধ্যা র্যা র্যা র্যা র্যা র্যা ধ্যা র্যা র্যা র্যা ধ্যারা।
🕸️সকলে। মার ব্যাটাকে মার ব্যাটার কান কেটে দে!
🕸️জাম্বুবান। ব্যাটার ধ্যার্যার্যার্যা চলেছে যেন রেকারিং ডেসিমাল।
🕸️সুগ্রীব। ব্যাটা, তুই ভালাে করে ধারাবাহিকরূপে আদ্যোপান্ত পর্যায় পরম্পরা সব বলবি কি না?
🕸️রাম। তারপরে কি হল শুনি ততঃ কিম্?
🕸️দূত। (গান) আসিছে রাবণ বাজে ঢক্ক ঢোল, মহা ধুমধাম মহা হট্টগােল।
🕸️সকলে। ততঃ কিম্, ততঃ কিম্, ততঃ কিম্?
🕸️দূত। শঙ্খ হুলাহুলি শানাই নিঃস্বন কর্তাল ঝঙ্কার অস্ত্রের ঝনন।
🕸️সকলে। ততঃ কিম্, ততঃ কিম্, ততঃ কিম্?
🕸️দূত। লাখাে লাখাে সৈন্য চলে সাথে সাথে
উড়িছে পতাকা সমুখে পশ্চাতে!
🕸️সকলে। ততঃ কিম্, ততঃ কিম্, ততঃ কিম্?
🕸️দূত। বীর দর্পে সবে করে কোলাহল
মহা আস্ফালনে কাঁপে ধরাতল।
🕸️সকলে। ততঃ কিম্, ততঃ কিম্, ততঃ কিম্?
🕸️দূত। তাহাদের রুদ্র দাপটের চোটে
ভয়ে প্রাণ উড়ে পিলে চমকে ওঠে।
🕸️সকলে। ততঃ কিম্, ততঃ কিম্, ততঃ
কিম্?
🕸️দূত। আজি দুর্দিনেতে নাহি কারাে রক্ষা।
দলে বলে সবে পাবে আজি অক্কা।
🕸️জাম্বুবান। চোপরাও বেয়াদব! মুখ সামলে কথা বলিস।
🕸️রাম। তুমি রাবণকে দেখেছ, এখান থেকে কত দূরে?
🕸️দূত। আজ্ঞে, এখেন থেকে প্রায় পাঁচ ঘণ্টার রাস্তা।
🕸️সকলে। হ্যাঁ–হ্যাঁ–পাঁচ ঘণ্টা, না পঁচিশ ঘণ্টা!
🕸️দূত। আজ্ঞে একটু দ্রুত হাঁটলে পােয়া ঘণ্টায় হতে পারে।
🕸️জাম্বুবান। তুমি কি করে আসছিলে? হামাগুড়ি দিয়ে?
🕸️রাম। কোন্দিকে আসছিল, বল তাে?
🕸️দূত। আজ্ঞে, তা তাে জিগগেস করি নি!
🕸️সকলে। ব্যাটা! তুমি আছ কোন্ কর্মে?
🕸️রাম। তাড়াতাড়ি আসছিল, না আস্তে আস্তে?
🕸️দূত। আজ্ঞে, তাড়াতাড়ি–আস্তে আস্তে। আজ্ঞে সেটা ঠিক ঠাওর করে দেখি নি?
🕸️সকলে। এটা কোথাকার অপদার্থ রে? দে, ওটাকে তাড়িয়ে দে।
🕸️বিভীষণ। (জাম্বুবানের প্রতি) মন্ত্রীমশাই! একটা কথা শুনুন! কানে-কানে বলব–
🕸️জাম্বুবান। উঃ-দূৎ! বনমানুষ কোথাকার! তাের দাড়িতে ভারি গন্ধ! শুনব না—
🕸️দূত। হাঃ–হাঃ–হাঃ–হাঃ–হাঃ–
🕸️বিভীষণ। বেটা হাসছিস কেন রে বেয়াদব?
বিভীষণের দূতকে প্রহার ও অর্ধচন্দ্র
সুগ্রীব। ওরে, কে কোথায় আছিস? আমার গদাটা নিয়ে আয় তাে।
🕸️সকলে। কেন? গদা কেন?
🕸️সুগ্রীব। রাবণকে ঠ্যাঙাব!
হনুমানের প্রবেশ
হনুমান। রাবণ বােধ হয় আসছে!
🕸️সকলে। যা–যা, ব্যাটা এতক্ষণে এক বাসি সংবাদ নিয়ে এসেছে!
🕸️সুগ্রীব। চল হে লক্ষ্মণ, আমরা যুদ্ধ করি গিয়ে–
[সকলের উত্থান ও প্রস্থান]
[ইতি সমাপ্তােয়ং লক্ষ্মণের শক্তিশেলাভিধেয়সা কাব্যস্য প্রথমাে সর্গঃ]
।। দ্বিতীয় দৃশ্য ।।
রণস্থল
সুগ্রীবের প্রবেশ
সুগ্রীব। (ভয়ে ভয়ে) কেউ নেই তাে?
সুগ্রীবের পদচারণা। বিভীষণের প্রবেশ
বিভীষণ। দেখ, হাঁটছে দেখ–বাঁদুরে বুদ্ধি কিনা!–দুৎ! যুদ্ধ করতে এসেছিস, ওমনি করে হাঁটলে লােকে বাঙাল বলবে যে!–এমনি করে হাঁট।
বিভীষণের হাঁটার নমুনা প্রদর্শন
সুগ্রীব। রেখে দাও তােমার ভড়ং! আমাদের দেশে ওরকম হাড়গিলের মতাে করে হাঁটে না!
🕸️বিভীষণ। তােদের দেশে আবার হাঁটতে জানে নাকি? আচ্ছা মানুষ তাে!
🕸️সুগ্রীব। মানুষ বললে কেন হে? খামখা গাল দিচ্ছ কেন?
নেপথ্যে জাম্বুবানের কণ্ঠস্বর
জাম্বুবান। ওরে তােরা পালিয়ে আয়, রাবণ আসছে।
বিভীষণ ও সুগ্রীব। অ্যাঁ–কি!
গান
যদি রাবণের ঘুঁষি লাগে গায়—
তবে তুই মরে যাবি—তবে তুই ম-রে যা-বি
ওরে, পালিয়ে যারে পালিয়ে যা
তা না হলে মরে যাবি–
লগুড়ের গুঁতাে খেয়ে হঠাৎ একদিন মরে যাবি।
বিভীষণ। ওরে আমার মনে পড়েছে—একটা বড্ড জরুরি কাজ বাকি আছে—সেটা চট করে সেরে আসছি।
[বিভীষণের প্রস্থান]
সুগ্রীব। এইবার বােধ হয় রাবণ আসবে–আজ একটা কিছু হয়ে যাবে–ইসপার নয় উসপার–
রাবণের প্রবেশ
গান
সুগ্রীব। তবে রে রাবণ ব্যাটা
তাের মুখে মারব ঝ্যাঁটা
তােরে এখন রাখবে কেটা
এবার তােরে বাঁচায় কেটা বল্।
(তোর) মুখের দুপাটি দন্ত
ভাঙিয়া করিব অন্ত
তাের এখনি হবে প্রাণান্ত
আয় রে ব্যাটা যমের বাড়ি চল।।
রাবণ। ওরে পাষণ্ড, তোর ও মুণ্ড খণ্ড খণ্ড করিব।
যত অস্থি হাড়, হবে চুরমার, এমনি আছাড় মারিব।।
ব্যাটা গুলিখোর বুদ্ধি নেই তাের নেহাত তুই চ্যাংড়া।
আয় তবে আয় ষষ্টির ঘায় করিব তােরে ল্যাংড়া।।
সুগ্রীব। রেখে দে তাের গলাবাজি
ওরে ব্যাটা ছুঁচো পাজি
অন্তিম সময় আজি
ইষ্টদেবে কর রে নমস্কার।
তুই রে পাষণ্ড ঘাের
পাল্লায় পড়িলি মাের
উদ্ধার না দেখি তাের
মাের হাতে না পাবি নিস্তার।।
রাবণ। ওরে বেয়াদব কহিলে যে-সব
ক্ষমা যােগ্য নহে কখন
তার প্রতিশােধ পাবি রে নির্বোধ
পাঠাব শমন সদন।।
রাবণের সুগ্রীবকে প্রহার
সুগ্রীব। ওরে বাবা ইকী লাঠি
গেল বুঝি মাথা ফাটি
নিরেট গদা ইকী সর্বনেশে!
কাজ নেই রে খোঁচা খুঁচি
ছেড়ে দে ভাই কেঁদে বাঁচি
সাধের প্রাণটি হারাব কি শেষে?
[সুগ্রীবের পলায়ন]
রাবণ। ছি, ছি, ছি—এত গর্ব করে, এত আস্ফালন করে, শেষটায় চম্পট দিলি? শেম্! শেম্!
লক্ষ্মণের প্রবেশ ও রাবণের গান
রাবণ। আমার সহিতে লড়াই করিতে
আগ্রহ দেখি যে নিতান্ত–
বুঝেছি এবার ওরে দুরাচার
ডেকেছে তােরে কৃতান্ত।
আমি পালােয়ান স্যান্ডাে সমান
তুই ব্যাটা তার জানিস কি?
কোথায় লাগে-বা কুরো পাট্কিন্
কোথায় রােজেদ্ ভেনিস্কি?
এই যে অস্ত্র দেখিছ পষ্ট
শােভিছে আমার হস্তে
ইহারই প্রভাবে যমালয়ে যাবে
বানর কুল সমস্তে।
অযােধ্যার লােকে যােদ্ধা হয়েছে
শুনে মরি আমি হাসিয়া
(আজি) দেখাব শক্তি রাখিব কীর্তি
দলে বলে সবে নাশিয়া ৷৷
লক্ষ্মণের লাঠি চালনা
লক্ষ্মণ। হ্যাঃ হ্যাঃ হ্যাঃ–হর হর হর হর–মার, মার, মার, মার, মার–কাট কাট কাট কাট কাট কাট–
লক্ষ্মণ শক্তিশেলাহত
লক্ষ্মণ। হা হতােস্মি!
লক্ষ্মণের পতন ও মূর্ছা। রাবণ কর্তৃক লক্ষ্মণের পকেট লুণ্ঠন। হনুমানের প্রবেশ
হনুমান। অ্যাঁ! কি হচ্ছে–দেখে ফেলেছি!
[রাবণের পলায়ন]
বানরগণের প্রবেশ ও গান
বানরগণ। অবাক কল্লে রাবণ বুড়াে–
ষষ্টির বাড়ি সুগ্রীবে মারি
কল্লে যে তার মাথা গুঁড়াে,
অবাক করলে রাবণ বুড়াে।।
(আহা) অতি মহাতেজা সুগ্রীব রাজা
অঙ্গদেরি চাচা খুড়াে
অবাক কল্লে রাবণ বুড়াে।।
(আরে) গদা ঘুরাইয়া দিল উড়াইয়া
লক্ষ্মণেরি ধড়া চুড়াে–
অবাক কল্লে রাবণ বুড়াে॥
(ওরে) লক্ষ্মণে মেরে বানর দলেরে
কল্লে ব্যাটা তাড়াহুড়ো
অবাক কল্লে রাবণ বুড়াে॥
(ব্যাটা) বুদ্ধি বিপুল যুদ্ধে নিপুণ
কিন্তু ব্যাটা বেজায় ভুঁড়ো,
অবাক কল্লে রাবণ বুড়ো।।
[লক্ষ্মণকে লইয়া বানরগণের প্রস্থান]
[ইতি সমাপ্তোয়ং লক্ষ্মণের শক্তিশেলাভিধেয়স্য কাব্যস্য দ্বিতীয়াে সর্গঃ]
।। তৃতীয় দৃশ্য ।।
রামচন্দ্রের শিবির
রাম, বিভীষণ ও জাম্বুবান
রাম। কিছু আগে একটা গােলমাল শােনা যাচ্ছিল—বােধ হয় কোথাও যুদ্ধ বেধে থাকবে।
🕸️বিভীষণ। তা হবে!
খোঁড়াইতে-খোঁড়াইতে ব্যাণ্ডেজবন্ধ সুগ্রীবের সকাতর প্রবেশ
বিভীষণ। আরে ও পালােয়ানজি, একি হল–ষাট ষাট ষাট।
সকলের উচ্চহাস্য
রাম। কি হে সুগ্রীব, তােমার যে দেখছি বহ্বারম্ভে লঘু ক্রিয়া হল।
🕸️বিভীষণ। আজ্ঞে, বজ্র আঁটুনি ফসকা গেরাে–
🕸️রাম। যত তেজ বুঝি তােমার মুখেই।
🕸️জাম্বুবান। আজ্ঞে হ্যাঁ, মুখেন মারিতং জগৎ–
🕸️রাম। আমি বলি কি তুমি মস্ত যােদ্ধা।
🕸️জাম্বুবান। যােদ্ধা বলে যােদ্ধা–ঢাল নেই তলােয়ার নেই খামচা মারেঙ্গা।
🕸️বিভীষণ। আমি বরাবরই বলে আসছি–
🕸️সুগ্রীব। দ্যাখ! তাের ঘ্যানঘ্যানানি আমার ভালাে লাগে না–
🕸️রাম। রাবণের কেন বল এত বাড়াবাড়ি?–
পিঁপড়ের পাখা উঠে মরিবার তরে।
জোনাকি যেমতি হায়, অগ্নিপানে রুষি
সম্বরে খাদ্যোত লীলা—
জাম্বুবান। আজ্ঞে ঠিক কথা রাঘব বােয়াল যবে সভে অবসর বিশ্রামের তরে–তখনি তাে মাথা তুলি চ্যাং পুঁটি যত করে মহা আস্ফালন।
বাহিরে গােলমাল
রাম। এত গােলমাল কিসের হে?
🕸️সুগ্রীব। রাবণ ইদিকে আসছে না তাে?
🕸️জাম্বুবান ও বিভীষণ। অ্যাঁ–রাবণ আসছে–অ্যাঁ?
🕸️বিভীষণ। আমার ছাতাটা কোথায় গেল? ব্যাগটা?
🕸️জাম্বুবান। হ্যাঁরে তাের গায়ে জোর আছে? আমায় কাঁধে নিতে পারবি?
জাম্বুবানের বিভীষণের কাঁধে চাপিবার চেষ্টা ও দূতের প্রবেশ
দূত। শ্রীমান লক্ষ্মণ আসছেন।
সকলে আশ্বস্ত
রাম। এত হল্লা করে আসছে কেন? চেঁচাতে বারণ কর।
🕸️দূত। আজ্ঞে, তিনি আসছেন ঠিক নয়–তবে হ্যাঁ, একরকম আসছেনই বটে—মানে তাঁকে নিয়ে আসছে।
🕸️জাম্বুবান। লােকটার কান মলে তাড়িয়ে দাও তাে–ব্যাটা হেঁয়ালি পাকাবার আর জায়গা পায় নি।
লক্ষ্মণকে ধরাধরি করিয়া সকলের প্রবেশ ও গান
বললেন যাহা জাম্বুবান(সাবাস গণৎকার হে)
আনুপূর্বিক ঘটল তাহা শুনতে চমৎকার হে।
পড়লেন লক্ষ্মণ শক্তিশেলে(যেন) ঝড়ে কলাগাছ রে—
খাবি খেতে লাগলেন যেন ড্যাঙায় বােয়াল মাছ রে।
অনেক কষ্টে রইল বেঁচে–(আহা) কপাল জোরে মৈল না–
(ওরে) স্বর্গ হৈতে কিচ্ছু তবু পুষ্পবৃষ্টি হৈল না!
ভাগ্যে মােরা সবাই সেথা ছিলাম উপস্থিত গাে–
তা নৈলে তাে ঘটত আজি হিতে বিপরীত গো!
রাম। হায়, হায়, হায়, হায়–হায় কি হল, হায় কি হল, হায় কি হল, হায় হায় হায়–
রামের মূর্ছা
বানরগণ। হায়-হায়-হায়-হায়-হায়-হায়, হায়-হায়-হায়-হায়-হায়-হায়, হায় কি হল-হল-হল-হল, হায় কি হল-হল-হল-হল-হল(ইত্যাদি)।
বানরগণের মাঝেমাঝে কলাভক্ষণ
জাম্বুবান। এতগুলাে লোক কি সেখানে ঘােড়ার ঘাস কাটছিল নাকি?
🕸️সুগ্রীব। হনুমান ব্যাটা কি কচ্ছিল?
🕸️হনুমান। আমি বাতাসা খাচ্ছিলুম।
🕸️সুগ্রীব। ব্যাটা, তুমি বাতাসা খাওয়ার আর সময় পাও নি?
সুগ্রীবের গান
শােন রে ওরে হনুমান
হও রে ব্যাটা সাবধান
আগে হতে পষ্ট ব’লে রাখি।
তুই ব্যাটা জানােয়ার
নিষ্কর্মার অবতার
কাজে কর্মে দিস বড় ফাঁকি।।
কাজ কর্ম ছেড়ে ছুড়ে
ঘুমােস খালি প’ড়ে প’ড়ে
অকাতরে নাকে দিয়ে তৈল–
শােন রে আদেশ মাের
এই দণ্ডে আজি তাের
অষ্ট আনা জরিমানা হৈল।
হনুমান। (স্বগত) মােটে আট আনা?
🕸️বিভীষণ। তারপর, তােমাদের মতলব কি স্থির হল?
🕸️সুগ্রীব। এইবার সবাই মিলে রাবণ ব্যাটাকে কিছু শিক্ষা দিতে হবে।
🕸️সকলে। হ্যাঁ! হ্যাঁ! ঠিক কথা। ঠিক কথা!
জাম্বুবানের নিদ্রা। সকলের গান
রাবণ ব্যাটায় মারো, সবাই রাবণ ব্যাটায় মারাে
(তার) মাথায় ঢেলে ঘােল(তারে) উল্টো গাধায় তোল
(তার) কানের কাছে পিটতে থাকো চোদ্দ হাজার ঢোল।।
কাজ কি ব্যাটার বেঁচে(তার) চুল দাড়ি গোঁফ চেঁচে
নস্যি ঢোকাও নাকে, ব্যাটা মরুক হেঁচে হেঁচে।
(তার) গালে দাও চুন কালি(তারে) চিমটি কাটো খালি
(তার) চৌদ্দপুরুষ উড়িয়ে দাও পেড়ে গালাগালি।
(তারে) নাকাল কর আলাে যে যেরকম পারাে
রাবণ ব্যাটায় মারাে, সবাই রাবণ ব্যাটায় মারাে।।
রামচন্দ্রের মূর্ছাভঙ্গ ও গাত্রোত্থান
বিভীষণ। এই যে, শ্রীরামচন্দ্র গাত্রোৎপাটন করেছেন!
🕸️রাম। তারপরে–ওষুধপত্রের কি ব্যবস্থা কললে?
🕸️সকলে। ঐ যা! ওষুধপত্রের তো কিছু ব্যবস্থা হল না?
🕸️রাম। মন্ত্রীমশাই গেলেন কোথা?
🕸️বিভীষণ। মন্ত্রীমশাই—একটু ঘুমােচ্ছেন।
🕸️সুগ্রীব। ব্যস! তবেই কেল্লা ফতে করেছেন আর কি!
🕸️সকলে। মন্ত্রীমশাই! আরে ও মন্ত্রীমশাই, আহা একবার উঠুন না!
সকলে মিলিয়া জাম্বুবানকে ঠেলাঠেলি ধাক্কাধাক্কি
বিভীষণ। বাবা! এ যে কুম্ভকর্ণের এক কাঠি বাড়া!
🕸️জাম্বুবান। (সহসা জাগিয়া) হ্যাঁরে, আমার কাঁচা ঘুম ভাঙ্গিয়ে দিলি, ব্যাটা বেল্লিক, বেরসিক, বেআক্কেল, বেয়াদব—হাঁড়িমুখাে ভূত!
🕸️সকলে। রাগ করবেন না–আহা রাগ করবেন না। কথাটা শুনুন।
সকলের গান
আজকে মন্ত্রী জাম্বুবানের বুদ্ধি কেন খুলছে না?
সঙ্কটকালে চটপট কেন যুক্তির কথা বলছে না?
সর্ব কর্মে অষ্টরম্ভা হর্দম পড়ে নাক ডাকছে–
উল্টে কিছু বলতে গেলে বিটকেল বিটকেল গাল পাড়ছে।
মরছে লক্ষ্মণ জানছে তবু দেখছে চেয়ে নিশ্চিন্তে
এম্নি স্বভাব ছিল না তার থাকতাম যখন কিঙ্কিন্ধে।
হাঙ্গাম দেখে হটলে পরে নিন্দুক লােকে বলবে কি?
ভেবেই দেখ এম্নি করলে রাজ্যের কার্য চলবে কি?
মুখ্যু মােরা আক্কেল-শূন্য এক্কেবারেই বুদ্ধি নেই–
সূক্ষ্মযুক্তি বলতে কারাে ঠাকুদ্দাদার সাধ্যি নেই।
বলছি মােরা কিচ্ছু নেইকো চটবার কথা এর মধ্যে
উঠে একবার ব্যবস্থা দেও প্রণাম করি ঠ্যাং
পদ্মে।।
হনুমান। (স্বগত) হ্যাঁরে, আমার লেজে পাড়িয়ে দিলি?
🕸️রাম। বুঝলে হে জাম্বুবান, তুমি কিনা হচ্ছ প্রবীণ লােক—এ সম্বন্ধে নিশ্চয়ই তােমার খুব অভিজ্ঞতা আছে—
🕸️জাম্বুবান। আজ্ঞে হ্যাঁ–সে কথা আগে বললেই হত—তা না ব্যাটারা খালি ধাক্কাই মারছে—মন্ত্রীমশাই, আরে ও মন্ত্রীমশাই’–আমি বলি বুঝি ডাকাত পড়ল নাকি?
🕸️রাম। হ্যাঁ, এইবার একটা কিছু ব্যবস্থা দিয়ে ফেল।
🕸️জাম্বুবান। (হনুমানের প্রতি) এই কাগজে যা প্রেশক্রিপশন লিখে দিচ্ছি, এই ওষুধ গুলাে চট করে নিয়ে আসতে হবে।
🕸️হনুমান। আচ্ছা, কাল ভোর না হতে উঠে নিয়ে আসব।
🕸️জাম্বুবান। না, না, এত দেরি করতে হবে না–এখুনি যা।
🕸️হনুমান। আবার এত রাত্তিরে কোথায় যাব? সাপে কাটবে না বাঘে ধরবে।
🕸️সুগ্রীব। ব্যাটা, সখের প্রাণ গড়ের মাঠ।
🕸️জাম্বুবান। না, ওষুধগুলাে এখনি দরকার।
🕸️হনুমান। আঃ! হােমিওপ্যাথি লাগাও না।
🕸️জাম্বুবান। যা বলছি শােন্। এই যা গাছের কথা লিখলাম–বিশল্যকরণী মৃতসঞ্জীবনী–এই-সব গাছের শেকড় আনতে হবে।
🕸️হনুমান। আমি ডাক্তারখানা চিনি নে।
🕸️জাম্বুবান। আ মরণ আর কি! একি কলকাতার শহর পেয়েছিস নাকি যে বাথগেট কোম্পানি তাের জন্যে দোকান খুলে বসবে? কৈলাস পাহাড়ের কাছে গন্ধমাদন পাহাড় আছে জানিস তাে?
🕸️হনুমান। কৈলেস ডাক্তার আবার কে?
🕸️জাম্বুবান। ব্যস! কানের পটহটা দেখি ভারি সরেস–ব্যাটা কৈলেস পাহাড় জানিস নে?
🕸️হনুমান। ও বাবা! সেই কৈলেস পাহাড়! এত রাত্তিরে আমি অত দূর যেতে পারব না।
🕸️জাম্বুবান। যাবি নে কি রে ব্যাটা? জুতিয়ে লাল করে দেব। এখুনি যা–দেখিস পথে মেলা দেরি করিস নে।
🕸️হনুমান। আমার কান কটকট কচ্ছে–
🕸️রাম। আহা, যারে যা, আর গােল করিস নে–নে বকশিশ নে।
হনুমানকে রামচন্দ্রের কলা প্রদান
হনুমান। যো হুকুম।
[কুর্নিশ করিতে-করিতে হনুমানের প্রস্থান]
জাম্বুবান। তারপর রাত্তিরের জন্য সেনাপতি নির্বাচন কর।
🕸️রাম। কেন? রাত্তিরে যুদ্ধ করবে নাকি?
🕸️জাম্বুবান। তা কেন? একজনকে একটু খবরদারি করতে হবে তাে! তা ছাড়া, হয়তো লক্ষ্মণকে নিয়ে যমদূতগুলোর সঙ্গে ঝগড়া হতে পারে।
🕸️সকলে। তা তাে বটেই। মন্ত্রীমশাই না হলে এমন বুদ্ধি কার হয়।
🕸️সুগ্রীব। (স্বগত) হ্যাঁ-হ্যাঁ, এইবার ভায়া বিভীষণকে কিঞ্চিৎ ফাঁপরে ফেলতে হচ্ছে–
সুগ্রীবের গান
আমার বচন শুন বিভীষণ
করহ গ্রহণ সেনাপতি পদ
(আহা) সাজ সজ্জা কর, দিব্য অস্ত্র ধর
সমরে সম্বর এ মহা বিপদ
(তুমি) বিপদে নির্ভীক বীর্যে অলৌকিক
তোমার অধিক কেবা আছে আর
(আহা) জলেতে পাষাণ যায় গাে ভাসান
মুশকিলে আদান প্রসাদে তোমার–
সকলে। ঠিক কথা—উত্তম কথা।
🕸️বিভীষণ। তাই তাে। মুশকিলে ফেললে দেখছি।
🕸️সুগ্রীব। শুন সর্বজনে আজিকে এক্ষণে
বীর বিভীষণে কর সেনাপতি
(আহা) শ্রীরামের তরে সম্মুখ সমরে
যদি যায় মরে কিবা তাহে ক্ষতি?
🕸️সকলে। তা তাে বটেই—কিচ্ছু ক্ষতি নেই।
🕸️জাম্বুবান। বেশ তাে! তাহলে তাই ঠিক হল–খবরদার। দেখ, ভালাে করে পাহারা দিও। কোন ব্যাটাকে পথ ছাড়বে না–স্বয়ং যম এলেও নয়।–আর দেখাে যেন ঘুমিও না।
[বিভীষণ ব্যতীত সকলের প্রস্থান]
বিভীষণ। ইকী গেরাে! ভালাে, আচ্ছা ফ্যাসাদে পড়া গেল দেখছি!
বিভীষণের গান
বিধি মাের ভালে হায় কি লিখিল
আজ রাত্রে একি বিপদ ঘটিল।
দুর্মতি সুগ্রীব চির শত্রু মাের
ফেলিল আমারে সঙ্কটেতে ঘাের।
জাম্বুবান ব্যাটা কুবুদ্ধির ঢেঁকি
তার চক্রে পড়ি নিস্তার না দেখি।
আসে যদি কেহ রাত্রি দ্বিপ্রহরে–
ঠেকাব কেমনে একাকী তাহারে?
স্বর্গ হতে কহ দেবগণ সবে
আজি এ সঙ্কটে কি উপায় হবে?
যম হস্তে আজি না দেখি নিস্তার
সুযুক্তি তাহার কহ সবিস্তার
শুন দেবাসুর গন্ধর্ব কিন্নর–
মানব দানব রাক্ষস বানর।
শুন সর্বজনে মাের মৃত্যু হলে
শােকসভা করাে তােমরা সকলে।
[ইতি সমাম্তােয়ং লক্ষ্মণের শক্তিশেলাভিধেয়স্য কাব্যস্য তৃতীয়াে সর্গঃ]
।। চতুর্থ দৃশ্য ।।
শিবির প্রাঙ্গণ
বিভীষণের পাহারাদারি, মধ্যে মধ্যে আয়নায় মুখোবলােকন ইত্যাদি
বিভীষণ। জাম্বুবান বলছিলেন, দেখ যেন ঘুমিও না–বাপু এমন অবস্থায় পড়ে যিনি ঘুম দিতে পারেন, তাঁকে আমি পাঁচশাে টাকা বকশিশ দিতে পারি!
বিভীষণের পদচারণা ও উঁকি-ঝুঁকি
তবে এ-পর্যন্ত যখন কোন দুর্ঘটনা হয় নি—তাতে আমার কিছু-কিছু ভরসা হচ্ছে–চাই কি, হয়তাে বিনা গােলযােগে রাত কাবার হয়ে যেতে পারে।…যাক! একটু ঘুমিয়ে নেওয়া যাক—যমের তাে ইদিকে আসবার কোনই গতিক দেখছি না—আর, আসলেই-বা কি? তাকে বাধা দেওয়াটা তাে আর বুদ্ধিমানের কার্য হবে না!
[বিভীষণের উপবেশন ও অচিরাৎ নিদ্রা।]
জাম্বুবানের প্রবেশ
জাম্বুবান। দেখেছ, আধ ঘণ্টা না যেতেই ঘোঁৎ-ঘোঁৎ করে নাক ডাকতে আরম্ভ করেছে—ওরে বিভীষণ(খোঁচা দিয়া) ওঠ্!
🕸️বিভীষণ। (লাফাইয়া উঠিয়া) কেরে! ও–জাম্বুবান যে–তুই বুঝি মনে করেছিলি আমি ঘুমিয়ে পড়েছি? আমি কিন্তু সত্যি করে ঘুমােই নি।
🕸️জাম্বুবান। হ্যাঁ হ্যাঁ—আমায় আর সমঝাতে হবে না। দিব্যি পড়ে নাক ডাকছে—আবার বলে, সত্যি করে ঘুমােই নি।
🕸️বিভীষণ। তুই টের পাস নি?—আমি মিটমিট করে চেয়ে দেখছিলাম।
🕸️জাম্বুবান। না-না–মিটমিট করে দেখলে চলবে না—ভালাে করে পাহারা দিতে হবে।
[জাম্বুবানের প্রস্থান]
বিভীষণ। ব্যাটা তো ভারি জোচ্চোর! আমার ঘুম ভাঙিয়ে দিল।
[বিভীষণের পুনরূপবেশন ও পুনর্নিদ্রা।]
যমদূতদ্বয়ের প্রবেশ
প্রথম দূত। হ্যাঁরে, বাড়িটা ঠিক চিনে এসেছিস তাে?
🕸️দ্বিতীয় দূত। আরে, হ্যাঁরে হ্যাঁ, এতদিন কাজ করেছি, একটা বাড়ি চিনতে পারব না?
🕸️প্রথম দূত। তােকে কি বাতলিয়ে দিয়েছিল বল্ তাে?
🕸️দ্বিতীয় দূত। আমাকে বলে দিয়েছে যে, সেই ডানদিকের উঠোনওয়ালা বাড়িটায় যাবি।
🕸️প্রথম দূত। ডানদিক তাে এই–আর উঠোনকে উঠোন মিলে গেছে, তবে তাে ঠিকই এসেচি–
🕸️দ্বিতীয় দূত। হ্যাঁ, চল–মড়াটা খুঁজে দেখি!
অন্বেষণ করিতে করিতে দূতদ্বয়ের বিভীষণোপরি পতন
বিভীষণ। কেরে! কেরে!
দূতদ্বয়ের লাফাইয়া তিন হাত দূরে গমন
প্রথম ও দ্বিতীয় দূত। এটা কি আছে রে! এটা কি আছে রে!
🕸️দ্বিতীয় দূত। ও বাপ্পো—এ মানুষ আছে নাকি?
🕸️প্রথম ও দ্বিতীয় দূত। ও বাপ্পাে—মানুষ? জীবন্ত মানুষ?
দূতদ্বয় ভয়ে কম্পিত
দ্বিতীয় দূত। কই রে কিচ্ছু তাে বলছে না।
🕸️প্রথম দূত। তাহলে বােধ হয় কিচ্ছু বলবে না।
🕸️দ্বিতীয় দূত। হ্যাঁ, বেশ অমায়িক চেহারা! ওকে জিগগেস কর তাে?
🕸️প্রথম দূত। তুই জিগগেস কর।
🕸️দ্বিতীয় দূত। তুই জিগগেস কর না! আমি তােকে ধরে থাকব–
🕸️প্রথম দূত। মশাই গাে–মশাই–শুনুন মশাই–একটু পথ ছেড়ে দেবেন মশাই–
🕸️দ্বিতীয় দূত। আমরা মশাই—গরীব বেচারা মশাই–
🕸️বিভীষণ। (স্বগত) এ তাে মজা মন্দ নয়! এরা দেখছি আমার ভয়ে থরহরি কম্পমান।
🕸️প্রথম দূত। চল একটু পাশ কাটিয়ে চলে যাই!
দূতদ্বয়ের পাশ কাটিয়া যাইবার উদ্যোগ
প্রথম ও দ্বিতীয় দূত। ওরে নারে, চোখ রাঙাচ্ছে।
দূতদ্বয়ের গান
দয়াবান গুণবান ভাগ্যবান মশাই গাে
তােমার প্রাণে একটুও কি দয়ামায়া নাই গাে?
তােমার তুল্য খাঁটি বন্ধু আর কাহারে পাই গাে?
তুমি ভরসা নাহি দিলে অন্য কোথা যাই গো!
এ সময়ে তােমা ভিন্ন কে আছে সহায় গো–
কার্যোদ্ধার না হলে তাে না দেখি উপায় গাে।
পথ ছেড়ে দাও মুক্ত কণ্ঠে তােমার গুণ গাই গাে
দয়াবান গুণবান ভাগ্যবান মশাই গাে।।
বিভীষণ। ভাগ ব্যাটারা, নইলে একেবারে প্রহারেন ধনঞ্জয় করে দেব।
উভয় দূতের পলায়ন ও পুনঃপ্রবেশ
প্রথম দূত। হ্যাঁরে, পালাচ্ছিস কোথা? খালি হাতে গেলে যমরাজা কাউকে আস্ত রাখবেন না!
🕸️দ্বিতীয় দূত। তাই তাে! তাই তাে! এ তাে ভারি মুশকিল হল–কি করা যায় বল্ দেখি?
🕸️প্রথম দূত। আয় না, আমরা ও ব্যাটার সঙ্গে লড়াই করি গিয়ে।
দূতদ্বয়ের গান
দ্বিতীয় দূত। যখন পরাজয় খলু অনিবার্য
তখন যুদ্ধ কি বুদ্ধির কার্য?
🕸️প্রথম দূত। তবে তাে মুশকিল উপায় কি হবে?
সাধ করে কেবল প্রাণটা হারাবে?
🕸️দ্বিতীয় দূত। আমিও তাই বলি লড়ায়ে কাজ নাই–
কাজেতে ইস্তফা এখনি দাও ভাই!
🕸️প্রথম ও দ্বিতীয় দূত। হায় কি ঘটিল হায় কি ঘটিল
এমন সাধের চাকুরি ঘুচিল।
🕸️বিভীষণ। ব্যাটারা রাত দুপুরে গান জুড়েছিস—চাবকিয়ে রোগা করে দেব।
দূতদ্বয় প্রস্থানােদ্যত ও দ্বারদেশে যমসহ সাক্ষাৎ
প্রথম ও দ্বিতীয় দূত। দোহাই মহারাজ, দোহাই যমরাজা, আমাদের কিছু দোষ নেই–ঐ এক ব্যাটা আমাদের পথ ছাড়ছে না।
যমের প্রবেশ
বিভীষণ। এই মাটি করেছে—এখন উপায়? আটকাতে গেলে যম মারবে, না আটকালে রাম মারবে। উভয় সঙ্কট! যা থাকে কপালে, ব্যাটাকে পথ ছাড়ব না। (সদর্পে) তবে রে ব্যাটা—আমায় চিনিস নে? আমি থাকতে তুই ঢুকবি?
যমের অগ্রসর হওয়া
দ্বিতীয় দূত। ওরে এবার লড়াই বাধবে–
🕸️প্রথম দূত। হ্যাঁরে ভারি মজা দেখা যাবে–
🕸️দ্বিতীয় দূত। (বিভীষণের প্রতি) পালা, পালা—এই বেলা পালা—
🕸️প্রথম দূত। হ্যাঁ, ঐ যে অস্তর দেখছ ওর একটি ঘা খেলেই সদ্য কেষ্ট প্রাপ্তি হবে।
🕸️বিভীষণ। তুই কে রে ব্যাটা মরতে এসেছিস?
যমের আবৃত্তি
কালরূপী মৃত্যু আমি যম নাম ধরি–
সর্বগ্রাসী সর্বভুক সকল সংহারি।।
সর্বকালে সমভাব সকলের প্রতি,
ত্রিভুবনে সর্বস্থানে অব্যাহত গতি।।
অন্তিমেতে দেখা দেই কৃতান্তের বেশে–
মাের সাথে পরিচয় জীবনের শেষে।।
সংসারের মহাযাত্রা ফুরায় যেমন—
শ্রান্তজনে শান্তি দেই আমিই শমন।।
পাহাড় লইয়া হনুমানের প্রবেশ
হনুমান। জয় রামের জয়!
যমের মাথায় হনুমানের পাহাড় স্থাপন। যমের পতন
প্রথম দূত। ও কি রে।
🕸️দ্বিতীয় দূত। ঐ যা! চাপা পড়ে গেল!
🕸️প্রথম দূত। তাই তো রে, চাপা পড়ল যে!
🕸️দ্বিতীয় দূত। (সকাতরে) হ্যাঁরে আমার মাইনে কে দেবে? প্রথম দূত। তাই তাে। আমারও যে পাওনা আছে।
🕸️প্রথম ও দ্বিতীয় দূত। ওগাে, আমাদের কি হলাে গাে—ওগাে, আমরা যে ধনে-প্রাণে মলুম গাে–(হনুমানের প্রতি) পালােয়ান মশাই গাে—সর্বনাশ কললেন গাে–হায়, আমাদের কি হল গাে–
দূতদ্বয়ের গান
প্রথম দূত। ওরে যম ব্যাটা যে দিল ফাঁকি
🕸️দ্বিতীয় দূত। মােদের তেরাে আনা মাইনে বাকি
🕸️প্রথম দূত। আহা দেখ না ব্যাটা হল নাকি?
🕸️দ্বিতীয় দূত। ওর চুল ধরে দে না ঝাঁকি।
🕸️প্রথম দূত। এই বিপদকালে কারে ডাকি হায় হায় যম ব্যাটা যে দিল ফাঁকি।–অ্যাঁক্
হনুমান কর্তৃক দূতদ্বয়ের গলা পাকড়ানাে
হনুমান। ভাগ! ভাগ!–ব্যাটারা গান ধরেছে যেন কুকুরের লড়াই বেধেছে।
[দূতদ্বয়ের প্রস্থান]
বিভীষণ। এবার সকলকে ডেকে নিয়ে আয়–
[হনুমানের প্রস্থান]
লক্ষ্মণকে ধরাধরি করিয়া হনুমানের সহিত সকলের প্রবেশ
সকলে। ওটা কিরে? ওটা কিরে?
🕸️হনুমান। আজ্ঞে, উপরেরটা গন্ধমাদন পাহাড়।
🕸️জাম্বুবান। ব্যাটা গােমুখ্যু কোথাকার, পাহাড়সুদ্ধ নিয়ে এসেছিস?
🕸️হনুমান। আজ্ঞে, গাছ চিনি নে। আর ঐ নীচেরটা–যমরাজা।
🕸️সকলে। আরে, আরে করেছিল কিরে ব্যাটা? করেছিস কি?
🕸️জাম্বুবান। থাক, ওমনি থাক। আগে লক্ষ্মণের একটা কিছু গতিক করে নিই, তারপর দেখা যাবে–
ঔষধান্বেষণ—ঔষধ প্রয়ােগে লক্ষ্মণের চেতনা লাভ
সকলে। বা, বা! কেয়াবাৎ। কেয়াবাৎ! কি সাফাই ওষধ রে!
🕸️হনুমান। হাজার হােক–স্বদেশী ওষুধ তাে।
🕸️সকলে। তাই বল। স্বদেশী না হলে কি এমন হয়।
🕸️জাম্বুবান। হ্যাঁ, এইবার যমকে ছেড়ে দাও।
পাহাড় সরাইয়া হনুমানের যমকে মুক্তিদান
যম। (চোখ রগড়াইয়া লক্ষ্মণের প্রতি) সেকি! আপনি তবে বেঁচে আছেন?
🕸️লক্ষ্মণ। তা না তাে কি? তুমি জ্যান্ত মানুষ নিয়ে কারবার আরম্ভ করলে কবে থেকে?
🕸️যম। আজ্ঞে, চিত্রগুপ্ত ব্যাটা আমায় ভুল বুঝিয়ে দিয়েছিল। আমি এখনি গিয়ে ব্যাটার চাকরি ঘুচোচ্ছি–
[যমের প্রস্থান]
লক্ষ্মণ। হনুমান ব্যাটা বুঝি ওকে চাপা দিয়েছিল—ব্যাটার বুদ্ধি দেখ।
🕸️হনুমান। তা বুদ্ধি থাকুক আর নাই থাকুক–ওষুধ এনে বাহাদুরিটা নিয়েছি তাে।
🕸️বিভীষণ। আমি পাহারা না দিলে ওষুধ কি হত রে—ওষুধ আনতে-আনতে যমের বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে যেত। আমারই তাে বাহাদুরি।
🕸️সুগ্রীব। অর্থাৎ কিনা আমার বাহাদুরি–আমি বললুম তবে তাে বিভীষণ পাহারা দিল—আর বিভীষণ পাহারা দিল বলেই তাে যমদূতগুলাে আটকা পড়ল।
🕸️জাম্বুবান। আরে ব্যাটা ওষুধের ব্যবস্থা করল কে? তােদের বুদ্ধি সে সময় উড়ে গেছিল কোথায়?
🕸️রাম। হ্যাঁ, সেটা ঠিক–কিন্তু আমি যুক্তির কথা না জিগগেস করলে তুমি হয়তাে এখনাে পড়ে নাক ডাকাতে।
🕸️লক্ষ্মণ। আর আমি যদি শক্তিশেল খেয়ে না পড়তাম তবে তাে এ-সব কাণ্ডকারখানা কিছুই হত না—আর তােমরাও বিদ্যা জাহির করতে পারতে না।
🕸️জাম্বুবান। যাক, এখন মেলা রাত হয়ে গেছে, তােমরা স্ব-স্ব গৃহে প্রত্যাবর্তন পূর্বক নিদ্রার চেষ্টা দেখ—তোমাদের মাথা ঠাণ্ডা হবে আর আমিও একটু ঘুমিয়ে বাঁচব।
🕸️হনুমান। আমায় কিছু বকশিশ দেবে না?
🕸️বিভীষণ। হ্যাঁ, ওকে চারটি বাতাসা দিয়ে মধুরেণ সমাপয়েৎ করে দাও।
🕸️প্রথম। আমার কথাটি ফুরােলো
🕸️দ্বিতীয়। নটে গাছটি মুড়লাে
🕸️তৃতীয়। ক্যান্ রে নটে মুড়োলি
🕸️চতুর্থ। বেশ করেছি–তাের তাতে কিরে ব্যাটা।
🕸️সকলে। ইত্যাদি, ইত্যাদি, ইত্যাদি।
[ইতি সমাপ্তোয়ং লক্ষ্মণের শক্তিশেলাভিধেয়স্য কাব্যস্য চতুর্থো সর্গঃ]
[সমাপ্তোয়ং মহানাটকঃ]
।। সমাপ্তি।।