কাঁচ
(সুকুমার রায়)
Text
এক ছিল সওদাগর। সে গেল বাণিজ্য করতে। প্যালেস্টাইনের তীরের কাছে নদীর মুখে তার ছোট্টো জাহাজটি বেঁধে সে তার লোকজন নিয়ে ডাঙায় নামল, আর সেখানেই বালির উপর আগুন জ্বেলে রান্না করতে বসল। হাঁড়ি বসাবার জন্য পাথর পাওয়া গেল না, কাজেই তাদের সঙ্গে যে সোডা-ক্ষারের পাটালি ছিল(যে সোডা দিয়ে বাসন সাফ করে) তারই কয়েকটার উপর তারা হাঁড়ি চড়াল। রান্না খাওয়া সব যখন শেষ হয়েছে, তখন তাদের সোডা-পাথরের চাক্তিগুগো তুলতে গিয়ে দেখলে তার চিহ্নমাত্র নেই—আছে কেবল স্বচ্ছ পাথরের মতন কি একটা জিনিস যা তারা আর কখনো চোখে দেখে নি। এমনি করে নাকি কাঁচের আবিষ্কার হয়েছিল। সেই থেকে আজ পর্যন্ত বালির সঙ্গে ক্ষার গলিয়ে লোকে কাঁচ তৈরি করে আসছে।
🕸️কলার ‘বাসনা’ পুড়িয়ে যে ছাই হয়, তার মধ্যে ক্ষার থাকে–তাকে বলে পটাশ ক্ষার। সোডা পটাশ চুন এই-সমস্তই নানারকমের ক্ষার। চুল্লির আঁচে শুধু বালি কখনো গলে না; কিন্তু তার সঙ্গে চুন-পাথর আর ক্ষার মিশিয়ে জ্বাল দিলে সব গলে এক হয়ে যায়, আর ঠাণ্ডা হলে কাঁচ হয়ে জমে থাকে।
🕸️প্রথম প্রথম মানষে যে কাঁচের ব্যবহার করত, সে কেবল শৌখিন জিনিস হিসাবে। কাঁচ তৈরি করবার সময় তার সঙ্গে নানারকম ধাতুর মসলা মিশিয়ে তাতে নানারকম রঙ ফলানো যায়। সেই-সমস্ত রঙিন কাঁচের পুঁথিমুক্তো এক সময়ে লোকে অসম্ভব দামে কিনে নিত। বহুমূল্য রত্ন বলে দেশ-বিদেশে তার আদর হত। সে সময়ে কাঁচ তৈরির সংকেত খুব অল্প লোকেই জানত; আর তারা কাউকে সে-সব শেখাত না। কিন্তু তবু দুশো-পাঁচশো বা হাজার বছরে সে-সব গোপন কথাও অল্পে অল্পে ফাঁস হয়ে যেতে লাগল। ক্রমে এশিয়া থেকে ইউরোপের নানা স্থানে এ বিদ্যার চলন হতে লাগল। বুদ্ধিমান রোমানেরা অতি অল্প সময়ের মধ্যেই কাঁচ তৈরিতে এমন উন্নতি করে ফেলল যে, কয়েকশো বছরের মধ্যেই কাঁচের শার্শী, বাসন, প্রদীপ-দান প্রভৃতি মানুষের অত্যন্ত ধনী লোকদের–নিত্য ব্যবহারের জিনিস হয়ে দাঁড়াল।
🕸️এখন আমরা যে-সমস্ত ঝক্ঝকে পরিষ্কার কাঁচ সদা সর্বদা ব্যবহার করি, তিনশো বছর আগে সেরকম কঁচ তৈরিই হত না। সে সময়কার কাঁচ হত ময়লাগোছের, তার মাঝে মাঝে ঘোলাটে দাগ থাকত। তার উপরেই রঙ ফলিয়ে, কৌশলে তার দাগের সঙ্গে দাগ মিলিয়ে ওস্তাদ কারিকররা আশ্চর্য সুন্দর সব জিনিস গড়ত। কিন্তু নিখুঁত সাদা কাঁচ যে কাকে বলে, সে তারা জানতই না। প্রায় তিনশো বছর আগে ইংলণ্ডের কয়েকজন উৎসাহী লোকের চেষ্টায় একরকম চমৎকার কাঁচ তৈরি হয়, সেই থেকেই কাঁচের ব্যবসার চূড়ান্ত উন্নতির আরম্ভ। তার আগে কাঠের চুল্লিতে কাঁচ তৈরি হত, এই ইংরাজেরাই সকলের আগে কয়লার চুল্লি ব্যবহার করলেন। এঁরা সমুদ্রের পানা পুড়িয়ে, তা থেকে পটাশ বার করে, সেই পটাশের মধ্যে খাঁটি চক্মকি পাথরের গুঁড়ো আর সীসা-ভস্ম মিশিয়ে জলের মতো স্বচ্ছ নূতনরকমের কাঁচ তৈরি করলেন। তখন হতে সেই কাঁচের শার্শী, সেই কাঁচের আর্শি, সেই কাঁচের যন্ত্র, বাসন, চশমা, দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়তে লাগল। শৌখিন ধনীর শখের কাঁচ সাধারণ লোকের ঘরোয়া জিনিস হয়ে উঠল।
🕸️লোহা না থাকলে মানুষের সভ্যতার শক্তি যেমন খোঁড়া হয়ে যায়, কাঁচ না থাকলে বিজ্ঞানের বুদ্ধিও সেইরকম কানা হয়ে পড়ে। এই তিনশো বছরের মানুষ তার জ্ঞানের পথে যা কিছু উন্নতি ও আবিষ্কার করেছে, কাঁচ না থাকলে তার প্রায় বারো-আনাই অসম্ভব হত। কাঁচ ছিল তাই দূরবীন হতে পেরেছে; কাঁচ ছিল তাই অণুবীক্ষণের জন্ম হয়েছে। আকাশের গ্রহ নক্ষত্রের আশ্চর্য রহস্য, গাছপালা কীটপতঙ্গের গঠন কৌশল, অসংখ্য রোগবীজের সঙ্গে স্বাস্থ্যের নিত্য লড়াই, অতি বড়ো ব্রহ্মাণ্ডের তত্ত্ব আর অতি সূক্ষ্ম অণুপরমাণুর ইতিহাস–এ সমস্তই মানুষ জানতে পারছে কেবল কাঁচের কৃপায়। গ্রহ নক্ষত্রের আলোক দেখে পণ্ডিতে তার মালমসলার বিচার করেন, তার ভূত-ভবিষ্যৎ কত কি বলেন–তার জন্যও কাঁচের বর্ণবীক্ষণ যন্ত্র চাই। ফোটোগ্রাফার ছবি তোলেন, তার জন্য কাঁচের লেন্স চাই। বৈজ্ঞানিকের ঘরে ঘরে কাঁচের থার্মোমিটার, ব্যারোমিটার, আরো নানারকম কত যন্ত্র আর কত ‘মিটার’। মোট কথা, কাঁচের ব্যবহার যদি মানুষে না জানত তবে আজও তার সভ্যতার ইতিহাস অন্তত তিনশো বছর পেছিয়ে থাকত।
🕸️নানারকম কাজের জন্য নানারকম কাঁচ তৈরি হয়। তা থেকে কাজের জিনিস গড়বার উপায়ও নানারকম। সামান্য একটা গেলাস, বোতল, চিমনি বা কাঁচের নল বানাবার জন্য কত যে কায়দা কৌশলের দরকার হয়, তা ভাবলেও অবাক হতে হয়। একটি কারিকর একটা লোহার নলে করে খানিকটা গলা কাঁচ নিয়ে, তার মধ্যে ফুঁ দিয়ে, তাকে নেড়ে ঝেড়ে দুলিয়ে ঝুলিয়ে চট্পট্ কত যে আশ্চর্য জিনিস গড়তে পারে সে একটা দেখবার মতো ব্যাপার। নলের মুখটা চুল্লিতে-চড়ানো তরল কাঁচের মধ্যে ডুবিয়ে নলের আগায় খানিকটা গলা কাঁচ উঠে আসে। তখন সেই নলের মধ্যে ফুঁ দিলে কাঁচটা গোল বুদ্বুদের মতো হয়ে ফুলে ওঠে। নরম থাকতে থাকতে সেই বুদ্বুদটাকে লোহার টেবিলের উপর ইচ্ছামতন চাপ দিয়ে চ্যাপ্টা করা যায়; অথবা গড়িয়ে ডিমের মতন বা হুঁকোর মালার মতন লম্বাটে করে দেওয়া যায়। কোনো জিনিস গড়তে গড়তে, তার খানিকটা জায়গা আগুনে তাতিয়ে আবার যদি ফুঁ দেওয়া যায় তা হলে সেই তাতান জায়গাটুকু গম্বুজের মতো ফুলে উঠতে থাকে। কিংবা যদি সেটাকে নরম অবস্থায় ঝুলিয়ে ধরে আস্তে আস্তে ঘোল-মউনির মতন পাক দেওয়া যায়, তা হলে যেখানটা নরম সেটা চিমনির ডাঁটা বা নলের মতন লম্বা হয়ে ঝুলে পড়ে। গোল জিনিসের গোড়ায় একটু নল বানিয়ে, তার পর আগার দিকটা গরম করে ফুঁয়ের জোরে ফাটিয়ে দিলে খাসা একটি বোতলের মুখ বা কলকে তৈরি হয়। এই-সমস্ত নানারকম জিনিসের গায়ে আবার খানিক নরম কাঁচ লাগিয়ে ইচ্ছামতো হাতল বা পায়া গড়ে দেওয়া যায়। এ-সব শিখতে যা সময় লাগছে, গড়তে গেলে ওস্তাদ লোকের তার চাইতেও কম সময় লাগে।
🕸️এইরকম অনেক জিনিসই আজকাল কলে তৈরি হয়। তার কতক গড়ে ঢালাই করে, কতক বানায় কল দিয়ে বাতাস ফুঁকে, আবার কতকগুলো তৈরি হয় নরম কাঁচের উপর অস্ত্র চালিয়ে। সাধারণ সরাসরি কাঁচ সমস্তই আগে অনেক হাঙ্গাম করে হাতে গড়ে তৈরি হত। তার জন্য প্রথমে ঘাড়-কাটা বোতলের মতো মস্ত মস্ত চোঙা বানিয়ে, তার পর সেইগুলোকে কেটে চিরে, নরম করে, চেপ্টিয়ে ছোটোবড়ো শার্শী তৈরি হয়। কিন্তু খুব বড়ো-বড়ো আরশি আর ভারী ভারী আসবাবী আয়নাগুলি প্রায় সমস্তই হয় ঢালাই করে। চুল্লির তরল কাঁচ গামলার মতো প্রকাণ্ড হাতায় করে তুলে একটা মস্ত টেবিলের উপর ঢেলে দিতে হয়। তার পর প্রকাণ্ড ‘রোলার’ দিয়ে সেই গরম কাঁচকে ক্রমাগত বেলে এবং দলে, শেষে পালিশ-করে ঘষে সমান করতে হয়।
🕸️সবচাইতে ভালো আর দামী যে কাঁচ সেগুলো দরকার হয় বিজ্ঞানের কাজে। তা দিয়ে দূরবীন হয়, ফোটো তুলবার ‘লেন্স’ হয়, হাজাররকম যন্ত্র তৈরি হয়। এই-সব কাজের জন্য যে কাঁচ লাগে, সে কাঁচ একেবারে নিখুঁত হওয়া দরকার। তার আগাগোড়া সমান স্বচ্ছ হওয়া চাই। জলের মধ্যে নুন ফেললে সে নুন যেমন গলে গিয়ে সমস্তটা জলের মধ্যে সমানভাবে ছড়িয়ে থাকে, ঠিক তেমনি করে কাঁচের সমস্ত মসলাগুলি সব জায়গায় ঠিক সমানভাবে সমান ওজনে মিশে যাওয়া চাই। তা যদি না হয়, কাঁচের মধ্যে কোথাও যদি অতি সামান্য একটুখানিও দাগী বা ঘোলা থেকে যায়, তা হলেই আর তা দিয়ে কোনো সূক্ষ্ম কাজ চলতে পারবে না। সুতরাং এই কাঁচ তৈরি করবার সময় খুব সাবধান হতে হয়। কয়লা বা গ্যাসের চুল্লির উপর পাথুরে মাটির বাসনের মধ্যে অল্প আঁচে একটু একটু করে কাঁচের মসলা জ্বাল দিতে হয়। দশ-বারো ঘণ্টা জাল দেবার পর, চুল্লির আঁচ বাড়িয়ে দিয়ে খুব কড়া আঁচের তাপে প্রায় চব্বিশ ঘণ্টা রাখতে হয়। তার পর ‘asbestos’ বা রেশমী পাথরের পোশাক-পরা মজুরেরা পাথরের ডাণ্ডা দিয়ে সেই তরল গরম কাঁচটাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ক্রমাগত ঘুঁটতে থাকে। একে আগুনের মতো গরম, তার উপর এই ভীষণ পরিশ্রম—এক মিনিট থামবার জো নেই। মজুরের পর মজুর আসে, তারা ঘেমে হাঁপিয়ে হয়রান হয়ে পড়ে, তাদের ঘাড়ে পিঠে ব্যথা হয়ে যায়, আবার তাদের জায়গায় নতুন মজুর আসে। ক্রমে চুল্লির আগুনও আস্তে আস্তে কমে আসতে থাকে—কাঁচটাও অল্পে অল্পে ঠাণ্ডা হয়ে জমে আসতে থাকে। এই সময়ে খুব সাবধান হওয়া দরকার। তাড়াতাড়ি জুড়িয়ে গেলে সবটা কাঁচ ঠিক সমানভাবে জমতে পারে না–এলোমেলোভাবে জমাট বেধে কাঁচের মধ্যে নানারকম ‘টান’ ধরে যায়; সে দোষ চোখে দেখা না গেলেও কাজের সময় ধরা পড়ে। সাধারণ কাঁচের জিনিসও তৈরি করার সময়ে তাড়াতাড়ি ঠাণ্ডা করে ফেললে ঠুনকো হয়ে যায়, নাড়তে-চাড়তে সহজেই ভেঙে যায়। তাই, কাঁচ যখন জমে আসতে থাকে তখনই চুল্লির চারদিকে ইঁটের দেওয়াল দিয়ে সব বুজিয়ে দিতে হয়; তার মধ্যে চুল্লির আগুন আস্তে আস্তে নিভে যায়। কাঁচটাও পাঁচদিন-দশদিন বা পনেরোদিন ধরে অল্পে অল্পে জমাট বেধে ঠাণ্ডা হয়ে আসে। তার পর দেওয়াল ভেঙে পাথুরে বাসন ভেঙে ভিতরকার কাঁচ বার করে আনে। সে কাঁচ যদি আস্ত থাকে তা হলে কাঁচওয়ালার খুব ভাগ্য*
হবে । প্রায়ই সেগুলো আট-দশ টুকরাে হয়ে ভাঙা অবস্থায় বেরােয়–তার মধ্যে ভালাে ভালো টুকরোগুলো বেছে নিতে হয়।*
দুরবীনের জন্য দু হাত-তিন হাত বা তার চাইতেও চওড়া নিখুঁত কাঁচের *
হয়।*
কাঁচ বারবার মতাে কারিকর পৃথিবীতে খুব কমই আছে।*
প্রায় সমস্তগুলিরই কাঁচ ঢালাই হয় ফ্রান্সের একটিমাত্র কারখানায়।*
সপ্তাহ আস্তে আস্তে চুল্লি জুড়িয়ে, নানারকম*
করা হয়। তবু প্রায়ই দেখা যায় কাঁচ ফেটে*
ঢালাই করে বার বার ভেঙে যায়।*
হয়তো। বিশ-ত্রিশ*
নিখুঁত কাঁচ বেরোয়। এইজন্যেই সে কাঁচের*
বিশ হাজার বা লাখ-দুই টাকা দাম লেগে যাগ!*
জন্য সাড়ে পাঁচ হাত চওড়া একখানি কাঁচের দরকার;*
তারা তা দিতে প্রস্তুত। আজ তেরাে বছর ধরে সেই*
কিন্তু এই এতদিন পরে সবে সেদিন মাত্র শোনা গেল যে,*
কাঁচখানির ওজন হবে একশো কুড়ি মণ আর তার*
লক্ষ টাকা।
সন্দেশ(ভাদ্র, ১৩২৬)
।। সমাপ্তি।।