চীনের পাঁচিল
(সুকুমার রায়)
চীনদেশের রাজা ছিলেন চীন্-শিঃ-হোয়াংতি। ‘চীন্’ মানে আদি রাজা—যার আগে আর কেউ রাজা ছিল না। আসলে কিন্তু তাঁর আগে অনেক রাজা ঐ চীনদেশেই রাজত্ব করে গিয়েছেন; কারণ হোয়াংতি যে সময়ে রাজা ছিলেন, সে হল মোটে দুহাজার বছর অগেকার কথা। তার আগে যাঁরা রাজা ছিলেন তাঁদের নামধাম, রাজত্বের তারিখ, বংশ পরিচয়, আর বড়ো-বড়ো কীর্তির কথা সমস্তই ইতিহাসের পুঁথিতে লেখা ছিল। কিন্তু হোয়াংতি বললেন, “তা হলে চলবে না। আমি হলাম আদি রাজা ‘চীন্’–আমার আগে আর কোনো রাজা-টাজার নাম থাকলে চলবে না। এখন থেকে নতুন করে আবার সব ইতিহাস আরম্ভ হবে।”
🕸️এই বলে তিনি হুকুম দিলেন, সেকালের ইতিহাসের যত পুঁথি যেখানে পাও সব খুঁজে এনে পুড়িয়ে ফেল। রাজার হুকুমে চারিদিক থেকে রাশি রাশি হাতের লেখা পুরানো বই জড়ো করে পোড়ানো হল।
🕸️কিন্তু শুধু বই পোড়ালে কি হবে? দেশের যাঁরা পণ্ডিত লোক, তাঁরা তো সে-সব বই পড়েছেন; এতদিন কিরকমভাবে দেশের কাজকর্ম হয়ে এসেছে তাও তাঁরা সব জানেন। রাজার এ-সব খামখেয়াল তাঁরা পছন্দ করবেন কেন? কাজেই আবার হুকুম হল, মারো সব সেকেলে পণ্ডিতদের। অমনি খুঁজে খুঁজে বড়ো-বড়ো পণ্ডিতদের ধরে এনে মেরে ফেলা হল।
🕸️কিন্তু এত কাণ্ড করেও রাজা যেরকম চেয়েছিলেন তেমনটি হল না। রাজা যখন মারা গেলেন তখন দেখা গেল এখানে সেখানে দু-চারটি বুড়ো-বুড়ো পণ্ডিত তখনো বেঁচে আছেন, প্রাচীনকালের কীর্তিকথা আইনকানুন সব তাঁদের মুখস্থ। তার পর সেকালের পুঁথিপত্র যা ছিল তাও দেখা গেল সব পোড়ানো হয় নি। এমন-কি, পুরানো একটা বাড়ির ভেতর থেকে আস্ত একটা লাইব্রেরিই বেরিয়ে গেল–যার মধ্যে আগেকার রাজারাজড়াদের অনেক কথাই লেখা রয়েছে। সুতরাং, রাজা হোয়াংতি কেবল নামেই আদি রাজা হয়ে রইলেন; মাঝ থেকে খালি কতগুলো বই নষ্ট করাই সার হল, অরি কয়েকশো নিরীহ পণ্ডিত মিছামিছি প্রাণ হারালেন। আর হোয়াংতি রাজার দুর্বুদ্ধির জন্য ইতিহাসে তাঁর দুর্নাম থেকে গেল।
🕸️জবরদস্তি করে রাজামশাই নাম কিনতে গিয়ে ঠকে গেলেন, কিন্তু আর-একদিকে সত্যি সত্যি তিনি এমন একটা কীর্তি রেখে গিয়েছেন যার জন্য আজও তাঁর নাম লোকে মনে করে রেখেছে। সেই কীর্তিটি হচ্ছে চীনদেশের রাজ্য-ঘেরা পাঁচিল। মানুষ যেমন করে তার দালানদুর্গ বা ক্ষেতবাগান দেয়াল দিয়ে আর বেড়া দিয়ে ঘেরে ঠিক তেমনি করে তিনি তাঁর রাজ্যের উত্তর আর পশ্চিম দিকে প্রকাণ্ড পাঁচিলের ঘেরাও দিয়েছিলেন। পুব সীমানার সমুদ্র থেকে উত্তরের পাহাড় পর্যন্ত, পাহাড়ের উপর দিয়ে পশ্চিমের মরুভূমি পর্যন্ত, উঁচুনিচু আঁকাবাঁকা, দেড়হাজার মাইল লম্বা প্রকাণ্ড দেয়াল। এমন আশ্চর্য বড়ো দেয়াল পৃথিবীর আর কোথাও নেই।
🕸️চীন সাম্রাজ্যের মধ্যে যে জায়গাটুকুকে ইংরাজিতে ‘চায়না’ বলা হয়, সেইটুকু হচ্ছে আসল চীনদেশ। মাঞ্চু আর তাতার জাতীয় দস্যুরা এই চীনদেশের লোকেদের উপর ভারি অত্যাচার করত। থেকে থেকে হঠাৎ দল বেঁধে এসে লোকের টাকাকড়ি ফল শস্য সব লুঠপাট করে তারা পালিয়ে যেত। তাদের ঠেকাবার জন্যই এই প্রকাণ্ড পাঁচিল। ভিতরে মাটির বাঁধ, বাইরে ইঁট-পাথরের গাঁথুনি, তার মাথার উপর টালিবাঁধানো রাস্তা, পাঁচিলের উপর দিয়ে লোকজন গাড়িঘোড়া সব যাতায়াত করে। এক-এক জায়গায় এমন চওড়া যে পাঁচ-সাতটা উটের গাড়ি অনায়াসে পাশাপাশি চলতে পারে। কোথাও দেয়ালের গায়ে প্রকাণ্ড ফটক, কোথাও সিঁড়ির মতো ধাপকাটা, কোথাও প্রহরীদের প্রকাণ্ড উঁচু পাহারা-ঘর। এমনি করে পাঁচিলের পথ চলেছে৷ পাহাড়ের গা বেয়ে ওঠানামা করতে করতে, কত প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড পর্বতের চূড়োয় ওঠে, আবার কত নদীর ধারে সমান জমিতে নেমে এসেছে।
🕸️দুহাজার দুশো বছর তার বয়স। সে যদি কথা বলতে পারত, তা হলে তার এই বুড়ো বয়সে কত আশ্চর্য কথাই শুনতে পেতাম। কত যুগের পর যুগ এই দেয়ালের বুকের উপর দিয়ে কত দেশ-বিদেশের লোক আসা যাওয়া করেছে–কেউ ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য, কেউ চুরি ডাকাতির জন্য, কেউ দলে-বলে রাজ্যজয়ের জন্য। তুর্কি, তাতার, মোঙ্গল, মাঞ্চু, চীন কার অস্ত্রের কত বিক্ৰম ঐ দেয়াল তার সাক্ষী। কত রাজার কত রাজবংশের কত অদ্ভুত কাহিনী, কত সুখ-দুঃখের ইতিহাস। হোয়াংতি রাজার বংশের বা ‘হান্’ বংশের প্রতাপের কথা–যার ভয়ে তুর্কি তাতার জব্দ হয়েছিল। তার পর অরাজক দেশে অশান্তির যুগ—যখন ঘরে শত্রু বাইরে শত্রু, তার মধ্যে রাজায় রাজায় লড়াই। তার পর ‘তাং’ রাজাদের দিগ্বিজয়ের কথা—তাঁরা যুদ্ধ জয় করতে করতে পারস্য আর কাম্পিয়ান থেকে কোরিয়ার শেষ পর্যন্ত রাজ্য দখল করে বসেছিলেন। তার পর ছোটোখাটো রাজাদের ইতিহাস পার হয়ে ‘সুং’ বংশের কত কীর্তির কথা–কত বড়ো-বড়ো কবি, কত বড়ো-বড়ো পণ্ডিত, আর চারিদিকে জ্ঞান বিজ্ঞানের কত আলোচনা।–সে সময়ে প্রথম ছাপার কল তৈরি করে মানুষে সকলের প্রথম পুঁথির লেখা ছাপতে শুরু করেছে। তার পর কেবলই যুদ্ধবিগ্রহ–মোঙ্গল সেনাপতি চেঙ্গিস খাঁ-র কাছে চীনেদের বার বার লাঞ্ছনা—আর শেষে কুবলাই খাঁ-র আমল থেকে একশো বছর ধরে চীনদেশে মোঙ্গলদের রাজত্ব। শুধু চীনদেশ কেন, এশিয়ার পূর্বকূল থেকে ইউরোপে হাঙ্গারি রাজ্যের সীমানা পর্যন্ত তাদের প্রচণ্ড শাসন। তার পর ‘মিং’ বংশের শৌখিনী চীন রাজাদের রাজত্ব আর শিল্প বাণিজ্যের কাহিনী। আজও পাঁচিলের কাছে কাছে তাঁদের সমাধি দেখতে পাওয়া যায়—তার চারিদিকে বড়ো-বড়ো পাথরের মূর্তি কবর পাহারা দিচ্ছে। তার পর ক্ৰমে মাঞ্চুদের হাতে চীনের দুর্দশা—আর মাঞ্চু রাজাদের হুকুমে চীনাদের টিকি রাখার নিয়ম আরম্ভ। সেই থেকে এই বিংশ শতাব্দী পর্যন্ত মাঞ্চু বংশের তা-ৎচিং বা ‘অতি শুদ্ধ’ রাজাদের রাজত্ব চলে এসেছে।
🕸️বুড়ো পাঁচিল এখন মরতে বসেছে। এত যুগ যুগ ধরে তার উপর কত যে চোট গিয়েছে, কত ভাঙা গড়া মেরামত, কত তালির উপর তালি, আর হাজার-দুহাজার বছর পরে হয়তো তার চিহ্ন খুঁজে বার করতে হবে। এখনই কত জায়গায় ইঁট পাথর সব ধ্বসে পড়ছে–মস্ত-মস্ত ফাটল দিয়ে আগাছা আর জংলি ফুল গজিয়ে উঠছে। আগেকার যুগে শত্রু ছিল যারা তাদের হয়তো-বা দেওয়াল দিয়ে ঠেকিয়ে রাখা যেত, কিন্তু এখনকার শত্রু যারা তাদের কামান গোলার সামনে দেয়ালের বাঁধ করবে কি? তাই দেয়ালের আর তেমন যত্নও নেই, চিকিৎসাও নেই। অনেক জায়গায় দেয়ালের পথ দিয়ে চলাফেরার সুবিধা হয় তাই সেই-সব জায়গায় এখনো লোকে দেয়ালের যত্ন করে, বছর বছর মেরামত করে। এত ভেঙেচুরে তবুও যা রয়েছে দেখলে অবাক হয়ে যেতে হয়৷ এক ইজিপ্টের পিরামিড ছাড়া সেকালের মানুষের তৈরি এত বড়ো কীর্তি আর পৃথিবীর কোথাও নেই।
সন্দেশ(আষাঢ়, ১৩২৭)
।। সমাপ্তি।।