মামার খেলা
(সুকুমার রায়)
মামা বললেন, “আয়, একটা নূতন খেলা খেলবি আয়।” শুনে সবাই দৌড়ে এসে বসল, “কি খেলা, মামা?”
🕸️মামা বললেন, “এ খেলার নিয়ম খুব সহজ, কিন্তু খেলতে হলে খুব হুঁশিয়ার হওয়া চাই। নিয়ম হচ্ছে এই যে, সবাই যেমন ইচ্ছা কথা বলতে পারবে, কিন্তু এক-একটা অক্ষর বাদ দিয়ে।” সবাই বললে, “সে আবার কিরকম?”
🕸️মামা—এই মনে কর, যেন ‘ক’ বলব না—এমন কোনো কথাই বলব না, যার মধ্যে কোথাও ‘ক’ আছে। যেমন–কলা, কৃপণ, হাল্কা, বাক্স এ-সব কিছুই বলতে পারব না। পটলা অমনি চট্ করে বলে উঠল, “এ আর মুস্কিল কিসের? ও-সব না বললেই হল।”
🕸️মামা বললেন, “না বললে তো হলই, কিন্তু না বলে পারিস কিনা একবার দেখ তো।”
🕸️পটলা আচ্ছা বেশ–এই দেখ, আমি ‘ক’ বলব না–
🕸️মামা–আচ্ছা আয় দেখি, আমার সঙ্গে গল্প কর, আমিও ‘ক’ বলব না। এই খেলা আরম্ভ হচ্ছে–ওয়ান টু থ্রি।–হ্যাঁরে পটলা, তুই এখন বোধোদয় পড়িস?
🕸️পটলা–বোধোদয়! সে তো কোনো কালে–ঐ যা! ‘ক’ হয়ে গেল। আচ্ছা দাঁড়াও, আবার বলছি। বোধোদয় আমি অনেকদিন হল–
🕸️হারু, বিশু, কালু–অ্যাঁ! ‘অনেক’ বললে যে!
🕸️পটলা–ও তাই তো। আচ্ছা বলছি–বোধোদয় আমার বহুত দিন হল শেষ হয়েছে–এখন চারুপাঠ দ্বিতীয় ভাগ পড়ছি।
🕸️মামা–বেশ বেশ, খুব বলেছিস। পড়াশুনো বেশ চলছে তো? না রোজ মাস্টারমশাই মার লাগান?
🕸️পটলা–ইস্! তা বৈ–বাস্ রে, বড্ডো সামলে গেছি। না মারবেন কেন? দুত্তরি এ ছাই খেলা।
🕸️হারু–আমি খেলব মামা–আমি ‘ল’ বলব না।
🕸️মামা–বলবি নে? আচ্ছা আমি এক্ষুনি বলাচ্ছি তোকে। আমিও ‘ল’ বাদ দিলাম–ওয়ান টু থ্রি। হ্যাঁরে হারু, তুই মাথা মুড়িয়েছিস কেন?
🕸️হারু–ওটা–ওটা নাপিতে কামিয়ে দিয়েছে।
🕸️মামা–নাপিতে কামড়িয়ে দিয়েছে কেন?
🕸️হারু–না, কামড়িয়ে নয়–কামিয়ে।
🕸️মামা–ও, কামিয়ে? কি দিয়ে? কাস্তে দিয়ে?
🕸️হারু–না, ক্ষুর দিয়ে–
🕸️মামা–বেশ বেশ। তা কিরকম করে কামায় একটু বুঝিয়ে দে তো, সবাই শুনুক।
🕸️হারু–এই একটা বাটির মধ্যে খানিকটা–ঐ যা! দাঁড়াও বলছি–খানিকটা Water দিয়ে তার পর একটা চামড়ার উপর ক্ষুর ঘষে ঘষে ধার দিয়ে, কচ্কচ্ করে—হু—কচ্কচ্ করে—
🕸️পটলা—কচ্কচ্ করে চালিয়ে দিল।
🕸️বিশু–বুলিয়ে গেল। না, তা হলেও হয় না—
🕸️হারু–কচ্কচ্ করে সব সাবাড় করে দেয়।
🕸️মামা–বেশ, বেশ, এই তো চমৎকার হচ্ছে। হুঁশিয়ার থাকা চাই আর চট্পট্ কথা জোগানো চাই। আচ্ছা, তোর বড়দা আসবে কবে?
🕸️হারু–(মাথা চুলকাইয়া) এই–আজকের দিনের পরের দিন।
🕸️মামা–দুপুরের ট্রেনে বুঝি?
🕸️হারু–না, বিকেল—ঐ যা! ‘ল’ হয়ে গেল।
🕸️কালু–আমি খেলব। আমি ‘ঘ’ বলব না।
🕸️মামা তার চেয়ে বল না, হয়ে ময়ে ‘হ্ম’ বলব না? সব গোলমাল চুকে যায়।
🕸️কালু–তা হলে কোনটা বলব না বলে দাও।
🕸️মামা—আচ্ছা, ‘ন’ বলিস নে। আয় দেখি–ওয়ান টু থ্রি–খেলাটা বুঝতে পেরেছিস তো?
🕸️কালু–হ্যাঁ।
🕸️মামা–কিরকম বুঝেছিস বল তো—
🕸️কালু–খুব ভালো।
🕸️মামা–(ভ্যাংচাইয়া) খুব ভালো। তুই কথা বলতে শিখেছিস কবে থেকে?
🕸️কালু—ছেলেবেলা।
🕸️মামা–আর এই বুড়োবেলায় বুঝি বোবামি শিখেছিস?
🕸️কালু–দ্যুৎ!
🕸️মামা–এটা দেখি আচ্ছা ঢ্যাঁটা–মুখ বুজেই থাকবে। ওরে, একটু কথা-টথা বল, চুপ করে থাকলে কি খেলা হয়?
🕸️কালু–(অনেক ভাবিয়া) মামা, তুমি কি খাও?
🕸️মামা–তোমার মাথা খাই। গাধা কোথাকার। বলি ঝগড়ার সময় কি তুই ঘাড় গুঁজে চুপ করে থাকিস্?
🕸️কালু–উঁহু।
🕸️মামা–কি করিস তা হলে?
🕸️কালু–ঝগড়া করি!
🕸️মামা–(চটিয়া) ঝগড়াটা কিরকম শুনি—(জিভ কাটিয়া) হ্যাঁ, কিরকম বল তো।
🕸️অমনি সকলের তুমুল চীৎকার–“’ন’ বলেছে—মামা ‘ন’ বলেছে—মামা কালুর সঙ্গে হেরে গিয়েছে।”
🕸️মামা বললেন, “যা! তোদের আর খেলাটেলা কিছু শেখাব না—তোরা বেজায় ফচ্কে হয়েছিস!”
সন্দেশ(আশ্বিন, ১৩২৭)
।। সমাপ্তি।।